সৌদি আরবে যেসব অবৈধ জিনিস নেওয়া যাবে না
October 19, 2024
সৌদি আরবে হজ্জ, ব্যবসা বা কাজের উদ্দ্যেশে জন্য ভ্রমণ করার সময়, ব্যক্তিগত কাগজপত্রের পাশাপাশি আপনি দেশটির ভিতরে যেসব জিনিস নিয়ে যাবেন তা জানার ক্ষেত্রেও সাবধানতার প্রয়োজন। সৌদি সীমান্ত কর্তৃপক্ষ বা কাস্টমস অথরিটি দেশটির নিরাপত্তা ও ইসলামিক নৈতিক মানদণ্ড সুনিশ্চিত করার জন্য কঠোর নিয়মাবলী প্রয়োগ করে। অসাবধানতা বা অজ্ঞতাবশত এই নিয়মাগুলো না মানলে ভ্রমণকারী ঐদেশে গুরুতর জরিমানা বা এমনকি আইনগত ব্যবস্থার মুখোমুখি হতে পারে।
সৌদি আরবে ভ্রমণ সহজ করার জন্য, দেশটির মধ্যে প্রবেশের সময় আপনার সাথে রাখা যাবে না, এমন পণ্যগুলির সম্পর্কে জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চলুন জেনে নেই সৌদিতে প্রবেশের সময় যেসব জিনিস সাথে রাখলে আপনি শাস্তির মুখোমুখি হতে পারেন সেগুলো সম্পর্কে।
সৌদি আরবে যেসব জিনিস নেওয়া যাওয়া অবৈধ
সৌদি সীমান্ত বন্দর/এয়ারপোর্টে নিষিদ্ধ পণ্যের তালিকা
১. সব ধরনের বড়ি, মদ, মাদকদ্রব্য এবং অবৈধ ওষুধ: সৌদি আরবে যেকোনো ধরনের অবৈধ ওষুধ, মদ, নেশাদার দ্রব্য এবং মন বা চেতনা পরিবর্তনকারী ড্রাগ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। দেশটি মাদক সংক্রান্ত অপরাধের জন্য জিরো-টলারেন্স নীতি অনুসরণ করে। এর ফলে এসব দ্রব্য পরিবহনে জড়িত থাকার প্রমাণ পেলে তাদের কঠোর শাস্তি দেওয়ার বিধান রয়েছে।
তবে কিছু শর্ত সাপেক্ষে প্রেসক্রিপশন ওষুধ নেয়া যায়। দেশটিতে প্রবেশের সময় বিমানবন্দরে বা পোর্টে প্রেসক্রিপশন ওষুধ সাথে নেওয়ার জন্য সৌদি খাদ্য ও ওষুধ কর্তৃপক্ষ (SFDA) এর কাছে আবেদন দাখিল করতে হয়। শুধুমাত্র নিজের ব্যবহারের জন্য প্রেসক্রিপশন ওষুধ নেয়া যায়। ওষুধ এর সাথে সাম্প্রতিক চিকিৎসা প্রতিবেদন বা রিপোর্ট (ছয় মাসের বেশি পুরনো নয়) অথবা রোগীর রোগ নির্ণয়, পরিকল্পনা এবং ডোজের নির্দেশাবলী সহ চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন থাকতে হয়। যিনি ওষুধ নিয়ে যাবেন তাকে এই মর্মে দায়িত্ব নিতে হয় যে, ওষুধটি শুধুমাত্র যার জন্য নেয়া হচ্ছে এবং তিনিই ব্যবহার করবেন। একমাসের বেশি সময়ের জন্য সৌদি আরবে গেলে, এক মাসে যে পরিমাণ ওষুধ লাগে শুধুমাত্র সে পরিমাণ ওষুধ সাথে নেয়া যাবে। আর এর কম সময়ের জন্য গেলে যে কয়দিনের জন্য যাবে, ঐ পরিমাণ ওষুধ সাথে নেয়া যাবে। যদি প্রেসক্রিপশনে ইনজেকশন জাতীয় ওষুধ থাকে, তাহলে ক্লিয়ারেন্স প্রক্রিয়াটি সৌদির স্থানীয় একটি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে করতে হয়।
সৌদি আরবে ওষুধ নিয়ে যাওয়া সম্পর্কে আরো জানতে আমাদের এই পোস্টটি পড়ুন।
২. নিষিদ্ধ ধোঁয়াবিহীন তামাক, ই-সিগারেট: সৌদি কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত নয় এমন নির্দিষ্ট তামাক পণ্য, যেমন সাদা পাতা, জর্দা, গুল, খৈনি, ই-সিগারেট ইত্যাদি তামাকজাত পণ্য কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। অবৈধ তামাক পণ্য নিয়ে প্রবেশ বা ব্যবহার করার ফলাফল গুরুতর হতে পারে, যার মধ্যে জরিমানা, কারাভোগ বা দেশ থেকে নির্বাসন অন্তর্ভুক্ত।
৩. জাল টাকা বা মুদ্রা: জাল টাকা বা মুদ্রা নিয়ে সৌদি আরবে প্রবেশ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। ভ্রমণকারীকে নিশ্চিত করতে হয় যে তার সাথে বহন করা সব টাকা বৈধ। ক্ষেত্রবিশেষে ভ্রমণকারীকে তার সাথে থাকা টাকার পরিমাণ সৌদি কাস্টম কর্তৃপক্ষের কাছে Declare বা ঘোষণা করতে হয়।
সৌদি আরবে অর্থ বা অর্থিক সম্পদ নিয়ে যাওয়া সম্পর্কে বিস্তারিত আমাদের এই পোস্টটি পড়ুন।
৪. সব ধরনের বারুদ,আতশবাজি: সকল প্রকারের ও আকারের ফায়ারওয়ার্কস বা আতশবাজি, বারুদজাতীয় দ্রব্য পরিবহন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। সৌদি সরকার এগুলিকে নিরাপত্তা ঝুঁকি হিসাবে বিবেচনা করে তাই দেশটিতে এগুলো নিয়ে প্রবেশ করা যাবে না।
৫. অস্ত্র এবং গোলাবারুদ: অনুমতি ছাড়া সৌদি আরবে সকল ধরনের অগ্নিশস্ত্র, গোলাবারুদ, অস্ত্র, ছুরি, কাঁচি, ব্লেড ইত্যাদি সম্ভাব্য অস্ত্র নেয়া নিষিদ্ধ এবং অবৈধ। অনুমতি ছাড়া এসব বস্তু সৌদিতে নেয়া এবং সাথে রাখার শাস্তি হিসেবে ৩০ বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে।
৬. মেস বা পেপার স্প্রে: কিছু দেশে ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য ব্যবহার করার অনুমতি থাকলেও, মেস, পেপার স্প্রে বা আঁখি পানি করানো স্প্রে বা মলম জাতীয় বস্তু সৌদি আরবে নেয়া এবং ব্যবহার নিষিদ্ধ। তাই সৌদিতে যাওয়ার সময় এগুলো সাথে রাখা যাবে না।
৭. অনৈতিক/অশ্লীল কন্টেন্ট ধারণকারী ডিস্ক এবং স্টোরেজ ডিভাইস: ইসলামিক এবং সামাজিক মূল্যবোধ লঙ্ঘন করে এমন কন্টেন্ট (ছবি, ভিডিও, ডিজিটাল মিডিয়া) সৌদি আরবে নিষিদ্ধ। ডিস্ক, ফ্ল্যাশ ড্রাইভ বা অন্য স্টোরেজ ডিভাইস যাতে পর্নোগ্রাফি বা আপত্তিকর ছবির মতো যেকোনো ধরনের অশালীন এবং অশ্লীল কন্টেন্ট রয়েছে সেগুলো নিয়ে দেশটি প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এছাড়াও লাইসেন্সবিহীন যেকোনো ধরনের মিডিয়া পরিবহন নিষিদ্ধ।
৮. নিষিদ্ধ বই এবং প্রকাশনা: সৌদি মিডিয়া মন্ত্রণালয়ের নিতিমালা বিরোধী যেকোনো মুদ্রিত উপাদান যেমন, বই এবং পুস্তিকা, পত্রিকা ইত্যাদি বস্তু অবৈধ এবং নিষিদ্ধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
৯. গোপন ক্যামেরা সম্বলিত বস্তু: গোপন ক্যামেরা সংযুক্ত রয়েছে এমন বস্তু, যেমন স্পাই পেন, চশমা বা গোপন ক্যামেরা সম্বলিত ডিভাইস ইত্যাদি সাথে রাখা নিষিদ্ধ। সৌদি আইন মানুষের গোপনীয়তা এবং নিরাপত্তাকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নেয়। তাই সৌদিতে প্রবেশের সময় এগুলো সাথে রাখাকে তারা অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করে।
১০. লেজার পেন, দূরবীক্ষণ, টেলিস্কোপ এবং ড্রোন: ভ্রমণকারীরা শুধুমাত্র একটি লাল লেজার পেন সাথে রাখতে পারবেন। তবে লেজারের শক্তি ৫ মিলিওয়াটের বেশি হবে না। ৫ মিলিওয়াটের চেয়ে শক্তিশালী লেজার এবং অন্য রঙের লেজার নিষিদ্ধ। এছাড়াও দূরবীক্ষণ যন্ত্র, টেলিস্কোপ এবং ড্রোন পরিবহন নিষিদ্ধ।
কিছু শর্ত সাপেক্ষে সৌদিতে ড্রোন নেওয়া যাবে তবে তা চালানোর জন্য Saudi Arabia’s General Authority of Civil Aviation (GACA) এর নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে।
১১. ইলেকট্রিক শক এবং ডিভাইস: ব্যাক্তিগত নিরাপত্তার জন্য ব্যবহৃত হয় এমন যেকোনো ধরনের ইলেকট্রিক শক দেওয়ার ডিভাইস, যেমন টেসার, স্টান গান, স্টান পেন ইত্যাদি পরিবহন করা নিষিদ্ধ।
১২. স্পিড রাডার ডিটেক্টর: স্পিড ক্যামেরা বা রাডার সিস্টেম শনাক্ত করতে ব্যবহৃত হয় ডিভাইস অবৈধ এবং সৌদি আরবে যাওয়ার সময় সাথে রাখা যাবে না।
১৩. আড়ি পেতে শুনার জন্য ব্যবহৃত হয় এমন ডিভাইস: যেকোনো ডিভাইস যা গোপন কথাবার্তা শুনতে ব্যবহৃত হয়, যেমন বাগিং ডিভাইস বা গোপন মাইক্রোফোন ইত্যাদি, সৌদি আরবে নেয়া নিষিদ্ধ।
১৪. অননুমোদিত বড়ি, ক্রিম এবং যৌন টনিক: সৌদি খাদ্য ও ওষুধ কর্তৃপক্ষের সাথে নিবন্ধিত নয় এমন ওভার-দ্য-কাউন্টার বা হার্বাল ওষুধ, বিশেষ করে যৌন টনিক, গর্ভপাতের বড়ি, উদ্দীপক বস্তু পরিবহন করা নিষিদ্ধ। কোনো নন-প্রেসক্রিপশন ওষুধ আনার আগে সবসময় কাস্টমস কর্তৃপক্ষের সাথে পরামর্শ করতে হবে।
১৫. এডাল্ট টয় এবং ডিভাইস: কৃত্তিম যৌন উদ্দীপক হিসেবে ব্যবহৃত হয় এমন যেকোনো উপাদান বা ডিভাইস, যেমন সেক্স টয় এর পরিবহন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
১৬. শুয়োরের মাংস বা ব্যাঙের মাংস ধারণকারী পণ্য: শুয়োরের মাংশ এবং ব্যাঙের মাংস রয়েছে এমন যেকোনো দ্রব্য সাথে রাখা বা পরিবহন নিষিদ্ধ।
১৭. কিছু বিশেষ ফল: ক্ষেত্র বিশেষে সৌদি আরবে কিছু বিশেষ ফল পরিবহন নিষিদ্ধ। গুরু ফল, জায়ফল এবং জায়ফল এর পাউডার ইত্যাদি দ্রব্যকে দেশটিতে অবৈধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ফল পরিবহনের পূর্বে সৌদি কাস্টমস কর্তৃপক্ষের সাথে পরামর্শ করতে হবে।
১৮. মিলিটারি পোশাক: সৌদি আরবে প্রবেশের সময় সাথে মিলিটারি পোশাক বা মিলিটারি পোশাক সদৃশ বস্তু সাথে রাখা নিষিদ্ধ। মিলিটারি কর্তৃক ব্যবহৃত যেকোন বস্তুও সাথে রাখা নিষিদ্ধ।
১৯. ধর্মীয় মূর্তি বা চিহ্ন: মানুষ বা প্রাণীর আকারের সব ধরনের মূর্তি বা বস্তু যা ধর্মীয় উদ্দেশ্যে এবং পূজার জন্য ব্যবহৃত হয়, যেমন বুদ্ধের মূর্তি, ধর্মীয় চিত্র ইত্যাদি। এছাড়াও ক্রিসমাস ট্রি, ক্রুস, ডেভিডের তারা বা অন্য কোনো বস্তু যা ইসলামী ধর্ম ছাড়া অন্য ধর্মের সাথে যুক্ত এমন বস্তু সাথে না রাখা ভালো। ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য অন্য ধর্মীয় গ্রন্থ সাথে রাখা যাবে। তবে শিশুদের খেলনা জাতীয় পুতুল বা মূর্তি সাথে নেয়া যাবে।
২০. জুয়া খেলার সাথে সম্পর্কিত বস্তু: ডাইস, পোকার চিপস, রুলেট বা জুয়া খেলায় অন্য যেকোন সামগ্রী সাথে রাখা অবৈধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
উল্লিখিত সামগ্রীগুলো বহন করলে তা বাজেয়াপ্ত, জরিমানা বা এমনকি কারাদণ্ডের কারণও হতে পারে। বিশেষত মাদক ও অনৈতিক বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে, সৌদি আরব তাদের কাস্টমস আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করে তাই দেশটিতে যাওয়ার পূর্বে এই বিষয়গুলো সম্পর্কে সচেতন থাকা অত্যন্ত জরুরী।
সৌদি কাস্টমসে Disclosure বা ঘোষণা করে যে পণ্যগুলি নিয়ে যেতে পারবেন
সৌদি আরবে বিমান, স্থল বা সমুদ্রপথে যাত্রা করার সময়, আপনার সাথে নিয়ে যাচ্ছেন এমন নির্দিষ্ট কিছু পণ্য কাস্টমস কর্মকর্তাদের কাছে ঘোষণা বা Disclosure করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এই পণ্যগুলি নিম্নরূপ:
১. নগদ অর্থ, স্থানান্তরযোগ্য আর্থিক সম্পদ, ধাতু বা অন্যান্য মুদ্রা: মোট SAR ৬০,০০০ বা এর সমতুল্য পরিমাণের বেশি নগদ অর্থ, স্থানান্তরযোগ্য আর্থিক সম্পদ, দামি গয়না, সোনা, রূপা, মুক্তা, মূল্যবান দাতব বস্তু ইত্যাদি পরিবহনের পূর্বে তা কাস্টমস পোর্টে উপলব্ধ ঘোষণা ফর্মে উল্লেখ করতে হয়।
২. বাণিজ্যিক পরিমাণে উপহার: যদি ব্যক্তিগত ব্যবহারের চেয়ে বেশি পরিমাণে অথবা SAR ৩,০০০ বা এর বেশি মূল্যের উপহার সামগ্রী ভ্রমণকারীর সাথে থাকে তবে তা কাস্টমস পোর্টে উপলব্ধ ঘোষণা ফর্মে উল্লেখ করতে হয়।
৩. যেকোনো তামাকজাত পণ্য: ২০০টি সিগারেট বা ৫০০ গ্রামের বেশি অনুমোদিত তামাকজাত দ্রব্য সাথে নেওয়ার ক্ষেত্রে তা কাস্টমস পোর্টে উপলব্ধ ঘোষণা ফর্মে উল্লেখ করতে হয়।
৪. যেকোনো নিষিদ্ধ পণ্যর ক্ষেত্রে: কিছু নিষিদ্ধ পণ্য যেমন ওষুধ, ড্রোন ইত্যাদি অনুমতি সাপেক্ষে নেওয়ার ক্ষেত্রেও তা কাস্টমস পোর্টে উপলব্ধ ঘোষণা ফর্মে উল্লেখ করতে হয়।
বিমানবন্দরে যাওয়ার আগে ইন্টারনেটে এই ঘোষণা ফর্মটি পূরণ তা প্রিন্ট করে নেওয়া যাবে। আবার বিমানবন্দরের ডিপার্চার লাউঞ্জ থেকেও এই ফর্মটি পূরণ করা যাবে।
প্রবাসী সেবা অভিবাসী কর্মীদের উদ্দেশ্যে নির্ভুল তথ্য উপস্থাপনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সকল তথ্য নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে সংগৃহীত। যে কোন ধরণের ভুল উপস্থাপনা এড়াতে আমরা আমাদের ওয়েবসাইট নিয়মিত আপডেট করছি। তারপরেও, আপনি যদি ওয়েবসাইটে কোন ধরনের ভুল তথ্য খুজে পান, তাহলে আপনি আমাদেরকে ই-মেইল অথবা ফেসবুক মেসেজের মাধ্যমে জানাতে পারেন। আমরা আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব।